রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫, ০৬:১৭ পূর্বাহ্ন

লেয়ারিংয়ের জালে পাচারের অর্থ ফেরত আনা কঠিন

অনলাইন ডেস্ক॥
বিদেশে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে জটিল ‘লেয়ারিং’ প্রক্রিয়ার কারণে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একজন কর্মকর্তা জানান, পাচারকারীরা প্রথমে বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনো দেশে এবং সেখান থেকে তুলনামূলক নিরাপদ কোনো তৃতীয় দেশে অর্থ স্থানান্তর করে। সরাসরি শেষ গন্তব্যে অর্থ না যাওয়ায়, কোনো বিদেশি আদালতে এটি বাংলাদেশের অর্থ প্রমাণ করা কঠিন। এই লেয়ারিং-ই অর্থ ফেরত পাওয়ার প্রধান অন্তরায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে অন্তত পাঁচটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে। প্রথমত, অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে হবে। তৃতীয় ধাপে, সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থাকে অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। চতুর্থ ধাপে, দেশের আদালতের রায়ের পর, পঞ্চম ধাপে গন্তব্য দেশের আদালতে আন্তর্জাতিক আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা করে পাচারকারীর বিরুদ্ধে রায় পেলে তবেই অর্থ ফেরত পাওয়া সম্ভব।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আট মাস পেরিয়ে গেলেও অর্থ ফেরতের তদন্ত মূলত দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিএফআইইউ-এর আরেক কর্মকর্তা জানান, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের সাত মাস পার হলেও, এই সময় যথেষ্ট নয়। এই সময়ে দেড় সহস্রাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা মূল্যের অর্থ ও শেয়ার উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বিএফআইইউ প্রধানের নিয়োগের পর পাচারকারী শনাক্তের কাজ কিছুটা গতি হারিয়েছে।

গত ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে বিদেশি ল ফার্ম নিয়োগ করা হয়েছে। কারণ এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় তাদের আগে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে এবং এই অর্থ ফেরত আনতে এক বছরের বেশি সময় লাগতে পারে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে এখনো অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, এ জন্য ‘স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি টাস্কফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের পর বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করা হবে। তবে এই প্রক্রিয়া কবে নাগাদ সম্পন্ন হবে, সে বিষয়ে তিনি কোনো নির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি।

বিএফআইইউ সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে আড়াই শতাধিক তদন্ত রিপোর্ট সিআইডি ও দুদকে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০টির অডিট রিপোর্ট সম্পন্ন হয়েছে এবং সেগুলোর ভিত্তিতে দুদক মামলা করা শুরু করেছে। অভিযুক্তরা বিগত সরকারের আমলে অবৈধ সুবিধা নেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। খুব শিগগির বাকিগুলোর অডিট সম্পন্ন করে দুদক ও সিআইডিতে পাঠানো হবে বলে বিএফআইইউ-এর একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।

গত ডিসেম্বরে পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করে সরকার এবং এর কার্যপরিধি বাড়ানো হয়। নতুন কার্যপরিধিতে অর্থ ও সম্পদ চিহ্নিত করা, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা, অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া, জব্দ সম্পদের ব্যবস্থাপনা, বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য সংগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সমন্বয় সাধনের মতো ছয়টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সোয়া চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. মাশরুর রিয়াজ মনে করেন, রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা এবং সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে মূলত অর্থ পাচার হয়েছে। বর্তমান সরকার এ বিষয়ে গুরুত্ব দিলেও, অর্থ ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে গৃহীত পদক্ষেপ সঠিক পথেই আছে বলে তিনি মনে করেন।

পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনার জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে এবং বিএফআইইউ এই টাস্কফোর্সকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী এই টাস্কফোর্সের কার্যক্রম সমন্বয় করবেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com